মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ - তাজউদ্দীন আহমদ

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশােধনী করে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রপতির সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে সৎ উদ্দেশ্যে বাকশাল গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দল পরিচালনা এবং যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একক ক্ষমতার অধিকারী হন তিনি। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহযােগী মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল গঠনের। বিরােধিতা করলেন। এ নিয়ে তাদের মতবিরােধ সৃষ্টি হয়। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ) গঠন করাটা তাজউদ্দীন সমর্থন করেননি।

তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ বইতে বাকশাল গঠনে তাজউদ্দীন আহমদের আপত্তি ও মন্ত্রিসভা থেকে তার পদত্যাগ অংশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিস্তারিত বর্ণনায় শারমিন লিখেছেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকল। নীতিগত ও আদর্শিক ব্যাপারে দুজন তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন। তাজউদ্দীন ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে তিনি আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, শেখ মুজিব যেদিন ইস্তফা দিতে বলবেন সেদিনই তিনি ইস্তফা দেবেন। নিজে থেকে ইস্তফা দিয়ে শেখ মুজিবকে বিব্রত করবেন না, আবার তার আজীবনের নীতি ও আদর্শের সঙ্গেও আপস করবেন না। তিনি রাগ করে ক’দিন অফিসে যাননি। তাজউদ্দীনের বাসায় এলেন বঙ্গবন্ধু। তার আসার খবর শুনে সৈয়দা জোহরা। তাজউদ্দীন উপরে গেলেন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তখন ভীষণ তর্ক চলছে। তাজউদ্দীন তাঁকে বলছেন, ‘মুজিব ভাই আজকে আমি আপনাকে যে কথাগুলাে বলবাে, আমি জানি আপনি সে কথাগুলাে যুক্তি দিয়ে খণ্ডাতে পারবেন না।’ বাকশাল গঠনের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বললেন তাজউদ্দীন।

তাজউদ্দীন তার চূড়ান্ত মতামত বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার। এই একদলীয় শাসনের সঙ্গে একমত নই… বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে, সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনাে পরিবর্তনের প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সবসময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র । যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডােরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পজিশন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য খােন্দকার মােশতাক আহমদ ও যুবলীগের ইয়ংটার্ক স্বাধীনতার পরই সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। ‘৭৪-এর ২৬ অক্টোবর সকাল দশটায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেওয়া হয়। বেলা ১১টায় মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকের অব্যবহিত পর তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করতে বলেন বঙ্গবন্ধু।

‘৭৪-এর ২৬ অক্টোবর দুপুর ১২.২২ মিনিটে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ উল্লাহ তার পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন। পদত্যাগের আগে তিনি অর্থ, বন, মৎস্য উন্নয়ন ও পশু পালন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে অফিস থেকে ফোন করে স্ত্রীকে জানালেন, “লিলি, আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। ১২টা বেজে ২২ মিনিটে আমি পদত্যাগপত্রে সই করেছি। দুপুর একটার কিছু পরে তাজউদ্দীন সরকারি বাসায় ফিরে এলেন বন্ধু আরহাম সিদ্দিকীর গাড়িতে করে। নিজের জন্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করলেন। পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই। বাড়ি ফিরে পিয়ন আমির হােসেনকে বললেন ছাদ থেকে পতাকা নামাতে। তিনি বাড়ি ফিরে আসার পরপরই বাড়ি লােকারণ্য হয়ে গেল। ড. কামাল হােসেন এলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। সকলেরই প্রশ্ন তার পদত্যাগ সম্পর্কে। হাসিভরা মুখে পদত্যাগ সম্পর্কিত প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গেলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না ।পরদিন সব পত্রিকার শিরােনামে তাজউদ্দীনের পদত্যাগের বিষয়টি প্রকাশিত হলাে। সরকার-প্রভাবিত কিছু কাগজে লেখা হলাে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করানাে হলাে। ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, “মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হলাে বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। …ছায়ার মতাে যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গােপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন।

চক্রান্তকারীদের প্ররােচনায় তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু এমনই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে তাজউদ্দীন মন্ত্রী থাকাকালে সরকারি সচিবকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন তাজউদ্দীনের কাছে কে আসে, কী কথাবার্তা হয় এসব খবর তাকে জানাতে। বহির্বিশ্বেও তাজউদ্দীনের পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হলাে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জমিরউদ্দিন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন সে দেশের জাতির জনক টুংকু আব্দুর রহমান। রাষ্ট্রদূত জানালেন যে তাজউদ্দীনের এই সরিয়ে দেওয়াটাকে তারা ভালাে মনে করছেন না।

মুক্তিযুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী যাকে সবাই চেনে, যিনি বাংলাদেশের জন্য সব দিকে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাকে কেন হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হলাে? জমিরউদ্দিন আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনকে চিঠির মাধ্যমে এবং ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদূত সরাসরি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়া জানালেন। রাষ্ট্রদূত বললেন, এটা অন্য কেউ নয়, তাজউদ্দীন। আমাদের মতাে গরিব দেশে তাজউদ্দীন যে কয়দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, শুধু ভিক্ষা করেই বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুকেরও যে ডিগনিটি, আত্মমর্যাদা থাকতে পারে তা তাজউদ্দীনের ছিল। তাই তিনি সবার মনে দাগ কেটেছেন। কাজেই তারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবেই।’

‘৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার অন্যতম মদদদাতা মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস হেনরি কিসিঞ্জারের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আগমনের প্রাক্কালে, মার্কিন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালােচক তাজউদ্দীনের পদত্যাগ লক্ষণীয় বিষয়। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, “তার মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে তাজউদ্দীনের গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল বাকশাল গঠনের প্রশ্নে নিয়ে দুজনের ভেতর কথা হয়, এবং তাজউদ্দীন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম যে কিছুতেই উচিত হবে না সে-কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। তার চূড়ান্ত বক্তব্যটি ছিল এই রকম: ‘মুজিব ভাই, এই জন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিলাম? যেভাবে দেশ চলছে, আপনিও থাকবেন না, আমরাও থাকব না। দেশ চলে যাবে আলবদর রাজাকারের হাতে।”

বাকশাল যখন গঠিত হয় তাজউদ্দীন অবশ্য তখন আর মন্ত্রিসভায় নেই; তবু তাকে নতুন দলের সাধারণ সম্পাদক হতে বলা হয়েছিল। প্রস্তাবটি নিয়ে গিয়েছিলেন তঙ্কালীন আইনমন্ত্রী মনােরঞ্জন ধর। তাজউদ্দীন তাকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হাজার সালাম । কিন্তু দাদা, আমি আর সহমরণের পার্টিতে যাব না।’ বাকশাল প্রসঙ্গে ন্যাপের মােজাফফর আহমদকেও তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারাও সহমরণের পার্টিতে যােগ দিয়েছেন। তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির স্বচ্ছতা এক্ষেত্রেও প্রকাশ পেয়েছে। বাকশাল গঠনের আগে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) নিয়ে যে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় তার ব্যাপারেও তাজউদ্দীনের আপত্তি ছিল। ওই ঐক্যকে ত্রিশূল আখ্যা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংকে তিনি বলেছিলেন, মনিদা, আপনারা ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করেননি, ত্রিশূল করেছেন।

এক শূলে মুজিব ভাই মারা যাবেন, অপর শূলে আপনারা ও আমরা। তারপরও বঙ্গবন্ধু তার বিশেষ সহকারী বা উপদেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। তাজউদ্দীনকে তার জন্য বঙ্গবন্ধুর কক্ষের পাশের কক্ষে বসার ব্যবস্থা করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হঠাৎ তাজউদ্দীনকে নিয়ােগদান থেকে বিরত থাকেন আওয়ামী যুবলীগের কয়েকজন নেতার চাপের মুখে বঙ্গবন্ধু তাকে বিশেষ উপদেষ্টা বা সহকারী পদে নিয়ােগ দেননি। পদত্যাগের পর সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে যান। বসেন দ্বিতীয় সারিতে। তার আসনে বসে আবদুর রব সেরনিয়াবাত। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে এমন মনসুর আলী তাজউদ্দীনের আসনে বসতেন। তাজউদ্দীনের ধানমন্ডির বাসায় ভাড়াটিয়া ছিল। ভাড়াটিয়াদের বিদায় দিতে সময় লাগে।

ভাড়াটিয়ারা চলে গেলে ৩৫ নম্বর হেয়ার রােডের সব আসবাবপত্র। বুঝিয়ে দিয়ে ২৮ নভেম্বর সপরিবারে তিনি নিজ বাসভবনে চলে আসেন। পদত্যাগের ক’ঘন্টা আগে থেকেই সাদা পোশাকে গােয়েন্দা সংস্থার লােকেরা সচিবালয় ঘিরে রেখেছিল। পদত্যাগ করার পরও তাজউদ্দীনের যেন মুক্তি মিলল। তার ওপর কড়া নজর রাখা হলাে। তার গতিবিধির ওপর রিপাের্ট করার জন্য সরকারি গােয়েন্দা সংস্থাগুলােকে নিযুক্ত করা হলাে। প্রথমে সরকারি বাসভবন, সেটা ছাড়ার পর নিজস্ব বাসভবনের ওপর নজর রাখা শুরু হলাে। তাজউদ্দীন দুঃখ করে বলতেন, ‘পাকিস্তান আমলেও যেমন পেছনে গােয়েন্দা লেগে থাকত, স্বাধীন বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা। তাজউদ্দীনের ভাই মফিজউদ্দিন আহমদ তখন গুরুতর অসুস্থ। তাকে চিকিৎসার জন্য তিনি মস্কো নিয়ে যেতে চান।

সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আঁদ্রে পপভের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। আঁদ্রে জানালেন দেশের বাইরে যাবার ভিসা নিতে হলে রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়ােজন। তাজউদ্দীন বললেন, যে দেশ আমার হাতে স্বাধীন হলাে সে দেশ থেকে আমি কাজে বিদেশে যাব আর আমাকে নিতে হবে অনুমতি! আমি যাব না। আমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্রাজেডি এই যে, পদত্যাগের পর তার ব্যক্তিগত কোনাে গাড়ি ছিল না। তার দুই মেয়ে রিকশায় চড়ে বা অন্যের গাড়িতে করে বেইলি রােডের ভিকারুননিসা স্কুলে যাতায়াত করতেন।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫

Post a Comment

0 Comments