ভিড়ের মধ্যে একাকী - তাজউদ্দীন আহমদ

ভিড়ের মধ্যে একাকী - তাজউদ্দীন আহমদ


তাজউদ্দীন আহমদকে (১৯২৫-১৯৭১) নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা শোনা গেল। শোনা কথায় খোঁজ লাগালাম। কিন্তু ঠিক আর ঠাওর করতে পারি না। তাজউদ্দীন আহমদ এ দেশে খুব পঠিত নন। আলোচিতও নন। তার অবশ্য কারণ আছে। যেসব গুণ থাকলে আলোচনার কিংবা বন্দনার শীর্ষে থাকা যায় তাজউদ্দীন আহমদ সেসব গুণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক ধরনের আড়ালে থাকা মানুষ। নীরব সাধক ঘরানার। নিজের কাজটা নিমগ্নতা আর সততার সঙ্গে করতেন। রাজনীতি ছিল তার প্যাশন, ভালোবাসা। জনগণের কিসে মঙ্গল হয় সেটাই ছিল তার অভীষ্ট লক্ষ্য। রাজনীতি করে নিজের যশ, খ্যাতি, অর্থবিত্ত হবে, এই ধারণার ওপর তার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত ছিল না।


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পর দিশেহারা জাতীর হাল ধরলেন যখন, ভারতে গিয়ে, প্রবাসে বাংলাদেশের প্রথম সরকার তৈরি করে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার সেই সময়ে গভীরভাবে অনুভব করেছেন তার নেতার অনুপস্থিতি। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত সরকারের যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, লড়ছেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মরণপণ যুদ্ধ, তখনো তিনি নিজের ব্যাপারে নির্ভিক উদাসীন। তার লক্ষ্য তখন দুই।

এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, দুই. মর্যাদার সঙ্গে স্বাধীন দেশে জীবিত বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা। দুটিই তার চাই। কেননা তিনি জানেন, প্রথমটি অর্জিত না হলে দ্বিতীয়টি অর্জন অসম্ভব। সেই দুরূহ কাজে তিনি অবিচল। হার মানেননি, ভাঙেননি, মোচড়াননি-নীতির কাছে তো বটেই নৈতিকতার কাছেও ছিলেন পাহাড়সম দৃঢ়। যুদ্ধদিনের অস্বাভাবিক সময়েও তাজউদ্দীন আহমদ ন্যূনতম নৈতিক বা মানবিক বিচ্যুতির পথে হাঁটেননি। এমনিভাবেই চলেছেন আমৃত্যু। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় জেলখানায় অন্য তিনজন সহকর্মীর সঙ্গে যখন তাকে খুন করা হচ্ছে, তখনো তিনি অবিচল। কোনো আপস, নীতিভঙ্গ তার রক্তে ছিল না।

লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিলেন বলে কৌশল পাল্টেছেন কিন্তু নীতিভ্রষ্ট হননি। এই নীতিনির্ভর জীবনযাপন করা এই ভূখণ্ডে ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। কেননা এই ভূখণ্ডের জল-হাওয়া-কাদা আর সংস্কৃতিতে নীতিনিষ্ঠ মানুষের টিকে থাকার কোনো অনুকূল পরিবেশ কোনো সময়ই সহজ ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদ জীবনভর সেই অসহজ, কঠিন কাজটিই করেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তার সহকর্মীদের বলতেন, ‘আসুন, আমরা এমনভাবে কাজ করি ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।’ তিনি বলতেন, ‘মুছে যাক আমার নাম তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।’

তো এরকম একজন মানুষকে নিয়ে উপন্যাস লিখলই বা কে? আর কেমন উপন্যাসই বা লেখা হলো যা এত মিডিয়ার ডামাডোলের মধ্যেও আমরা জানতে পারলাম না। এসব উচাটনের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যিনি ওই উপন্যাসটির সাক্ষাৎ সাক্ষী। খোঁজ চলল। একসময় উপন্যাসটি হাতে এলো। খুঁজে পাওয়া গেল উপন্যাসের নিভৃতচারী সেই তরুণ লেখককেও। উপন্যাসের নাম, ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’। লেখকের নাম, সুহান রিজওয়ান। সর্বশেষ ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে বইটি ২০১৬ সালে। ইতিহাসের বয়ানে উপন্যাসটি লেখা।

উপন্যাসের মূল ব্যক্তিটি বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
উপন্যাসের মুখবন্ধেই লেখক লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আর তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস যতই পড়ি, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে মুগ্ধতা আমার ততই বাড়ে। মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রতিটি রচনার, প্রতিটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের লেখকরা যখন এই মানুষটির প্রসঙ্গে কথা বলেন; তখন তাদের উচ্ছ্বাসের মাত্রা দেখে বোঝা যায়, স্বাধীনতার প্রতি তাজউদ্দীনের আত্মমগ্নতার সীমা ছিল না কোনো। যুদ্ধদিনে এই অন্তর্মুখী মানুষটি অসম্ভব দৃঢ়তা দেখিয়ে স্বাধীনতার শত্রুদের হতাশ করেছেন বারবার, তবুও স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে দেখাটা অন্য অনেকের মতোই আমার জন্যও ছিল তীব্র বেদনার। সেই বেদনাবোধ ছড়িয়ে দিতেই ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’ লিখে ফেলা।’

দুই.
ইতিহাসের রেওয়াজও বোধ হয় এই। বড় জিনিস আমরা সহজে খুঁজে পাই না। হইচই আর ডামাডোলের আড়াল থেকে খুঁজতে হয় অমূল্য রতনকে। এই তরুণ হয়তো সেই কাজটিই করেছেন। একটা সময় ছিল যখন তাজউদ্দীন আহমদের নাম নিলেও তার সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা নেওয়ার মেটারিয়াল খুব একটা সহজ ছিল না। এখন তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা, চিঠিপত্র, ডায়েরির একটা ন্যূনতম সংগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে হয়তো এসব বইপত্র বা প্রকাশনার একটা মূল্য থাকবে।

তিন.
তাজউদ্দীন আহমদকে খুঁজে পেতে তরুণদের এই চেষ্টার আরেকটা বড় উদাহরণ হচ্ছে, ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও উন্নয়নে তাজউদ্দীন আহমদ : একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক পিএইচডি থিসিস রচনা। ইতিহাসের ছাত্র সরকারি কলেজের শিক্ষক কামাল হোসেন এই থিসিস রচনা করেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পান পিএইচডি ডিগ্রি। পিএইচডির এই থিসিস পরে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ‘তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’ শিরোনামে বই আকারে বের হয় ২০০৮ সালে। তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতি, কর্ম ও সমাজ চিন্তার ক্ষেত্র জানার জন্য এই বই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। বলা চলে তথ্য ও রেফারেন্স সমৃদ্ধ এই বইটি তাজউদ্দীন আহমদের সামগ্রিক জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণালব্ধ একটা আকর গ্রন্থও বটে। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তরুণ গবেষক কামাল হোসেন পিএইচডি লিখেছেন, বড় বিস্ময়ের ব্যাপার যার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অসীম ধৈর্য ও দৃঢ়তা ছাড়া দেশ স্বাধীন হতো কি না, সন্দেহ রয়েছে সেই তাজউদ্দীন আহমদ ইতিহাসে নির্বাসিত প্রায়।

তাকে কেবল কিছুসংখ্যক উন্নত রাজনীতিমনস্ক মানুষ স্মরণ করেন। সংখ্যায় কম হলেও তারা বাঙালি জাতির এই সাফল্য-ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ ও ইতিহাস জানতে আগ্রহী। এই শ্রেণিটির মনে তাজউদ্দীন আহমদ, অপরাপর নেতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ ও শ্রদ্ধাবোধ গবেষণা কাজে আমাকে অধিক যত্নবান হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তাদের উচ্চ ধারণা সমানভাবে সর্বত্র লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এমন একজন নেতা যার সম্পর্কে প্রশংসা ছাড়া নেতিবাচক কথা শোনা যায় না। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও উন্নত চেতনাসম্পন্ন। রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন। বোঝা যায়, ইতিহাসের এই আবিষ্কার ক্রমশ তাজউদ্দীন চর্চায় তরুণদের একটা অংশের অনেককে উৎসাহিত করছে।

চার.

 ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদের নিজের লেখা ডায়েরিগুলোর অধিকাংশই এখন আর পাওয়া যায় না। বলা চলে মিসিং। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার বাড়ি দখল করে সব মালামাল নিলামে বিক্রি করে দিলে অমূল্য এই ডায়েরিগুলো চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মাত্র কটি ডায়েরি বিভিন্ন সূত্রে অন্যদের হাতে থাকায় নানাভাবে পরবর্তী সময়ে পরিবারের হাতে ফিরে আসে। চারটি খণ্ডে সেসব ডায়েরির বাংলা অনুবাদ ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ‘তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫৪’ নামে আরেকটি ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে ২০১৭ সালে। এই ডায়েরির রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অসীম।

কেননা ১৯৫৪ সাল এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে এক বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের কাছে ক্ষমতাবান মুসলীম লীগের করুণ পরাজয় ঘটে। ২৯ বছর বয়সী তরুণ তাজউদ্দীন নিজেও মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হন। তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৫৪ সালের এই ডায়েরির রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য আরও বেড়ে গেছে এর একটি চিন্তাশীল সুদীর্ঘ ভূমিকা বইটিতে সন্নিবেশিত হওয়ার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা এই চিন্তা জাগানিয়া ভূমিকায় তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে। বলা চলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই লেখা পাঠ করে এক নতুন তাজউদ্দীন আহমদকে আমরা আবিষ্কার করি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখছেন, ‘তার (তাজউদ্দীন আহমদ) চরিত্রের ভেতরে ছিল মায়ের গুণ। ছিল ধৈর্য ও সহ্যশক্তি। একাত্তরে যার চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি। কলকাতাতে যেভাবে তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করেছেন, সেটি ধৈর্যশীল ও সহ্যশক্তিসম্পন্ন মায়ের; অস্থির পিতার নয়। হুঙ্কার দেননি, নীরবে কর্তব্য পালন করে গেছেন। টানাপড়েন ছিল, ছিল অসংখ্য সমস্যা, কিন্তু মোকাবেলা করেছেন নীরবে, মায়েরা যেমন করেন। যুদ্ধ চলছে, দলের ভেতরে ষড়যন্ত্র, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন, সামাল দিচ্ছেন সেনাপতিদের, শরণার্থীদের কথা ভাবতে হচ্ছে সর্বদা। অভাব-অভিযোগ অন্তহীন। সবকিছুর মোকাবেলা করছেন একাকী। অভিযোগ করবেন এমন কোনো জায়গা নেই। মায়েদের সেটা থাকে না। থাকতে নেই।’

পাঁচ.
ইতিহাসের বাঁকবদলে ভূমিকা রাখা বা তা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা সবার হয় না। ইতিহাসের বাঁকবদল দেখা নয় তা পরিবর্তনের এক যুগসন্ধিক্ষণে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ইতিহাসের সোনালি পথে খোদাই হয়ে গেছে তার নাম। চাইলেও তা মোছা যাবে না। সম্ভব নয়। তবুও ইতিহাসের পরিহাস হচ্ছে, সেই চেষ্টাও কখনো কখনো চলে। তাজউদ্দীন আহমদও ইতিহাসের সেই পরিহাসের শিকার।
তবুও চিন্তাশীল তরুণরা, অভিজ্ঞ নির্মোহ মানুষরা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লিখছেন, ভাবছেন। কেননা তারা বুঝেছেন বড় বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে এর বড় মানুষদের সামনের কাতারে দাঁড় করাতেই হবে। গোপন করে নয়, ইতিহাসের প্রকৃত সত্যটাকে আরও বড় করে তুলে ধরতে হবে। ক্ষীণ হলেও সেই চেষ্টা চলছে বলে ভিড়ের মধ্যে একাকী থাকা মানুষটিকে নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক আশাবাদ টিকে থাকছে, থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ জন্মেছিলেন ২৩ জুলাই, ১৯২৫ সালে। তার জন্মদিনে রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
kibria34@gmail.com

Post a Comment

0 Comments