স্মৃতির পাতা থেকে - সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

একটা মর্মান্তিক যন্ত্রণার উপলব্ধি যেন আজও আমাকে তাড়িত করে, কত জীবন্ত জ্বলন্ত..........।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মোড়কে আবৃত সে আমার নিজস্ব উপলব্ধি। চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার সংবাদে।
আজ থেকে ২২ বৎসর পূর্বে, অগনিত মানুষের ভিড়ে সেই নিদারুণ খবর- কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে তাজউদ্দিন সহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা। সেদিনের আমার সেই চীৎকার পরমুহুর্তেই থেমে গিয়েছিল। এক অব্যক্ত উপলব্ধি যা আমার সকল সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল সুদূরপ্রসারী গভীর আশঙ্কায়। নিমেষেই যেন জেগে উঠে দেখলাম, হায়! নিছক ক্ষুদ্র একা এই আমি আমার স্বামী হারিয়েছি, আমার সন্তানেরা বাবাকে হারাল, কিন্তু দেশ জাতি সমাজ সংসার আজ কাকে হারাল! সেদিন সেই মুহূর্তে লজ্জায় মাথা নত হয়েছিল আমার, আমারই কাছে। কোটি কোটি মানুষের ক্ষতির সাথে আপন ক্ষতি অভিন্ন একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন, ব্যক্তি আমি ক্ষতি জীবনভর তাই মূল্যহীন হয়েই থাকল।

এই পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয় যাদের জ্ঞান, মেধা, মননশীলতা দেশ ও জাতির সেবায় সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত থাকে। তারা অনুশীলনের এ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেকে তৈরি করেন, অন্তরে জাগ্রত রাখেন আপন দেশপ্রেমবোধ। নিরহঙ্কার, নির্লোভ চরিত্রের মানুষ তাজউদ্দিন। আজীবন চলেছেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথের মধ্য দিয়ে।

তাজউদ্দিন আজীবন সময়ের মুহূর্তগুলোকে মহামূল্যবান রত্ন দিয়ে সাজিয়েছেন। সময়ের আয়োজনকে দেশের মানুষের কাজে সদা নিয়োজিত রেখেই আগামি দিনের একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার বাস্তব চিত্র একেছেন। কৃচ্ছতাসাধন যার জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এক অসাধারণ নির্মোহ অভিব্যক্তির ধারক তাজউদ্দিন তার শাণিত জাগ্রত বিবেকের অনুশাসনে জীবনে কখনও সীদ্ধান্তহীনতার ধুম্রজালে নিজেকে আচ্ছন্ন রাখেননি।

বহু ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডের মুহূর্তলোতে তার সিদ্ধান্ত ছিল নির্ভুল, নিখাদ, অটল। যার বিচার-বিশ্লেষণ আজ দেশের জন্য মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে। মনে পড়ছে, সেই ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল, তাজউদ্দিন চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে, কাঁধে তুলে নিলেন ঐতিহাসিক মহান দায়িত্ব। আমরা প্রতি মুহুর্তে উৎকণ্ঠিত চিত্তে, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত অবস্থায়, অস্থির হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। গোলাগুলি চলছে অবিরাম, সে রাত্রে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিল।

লক্ষ মানুষের লাশের পাহাড় জমেছিল বাংলার জনপদে, পথে, প্রান্তরে। আমরা পলায়নরত অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে যেন আলিঙ্গন করছি। সেই সময় তাজউদ্দিন প্রবাসে সরকার গঠনের লক্ষ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন, পথে কোন এক বন্ধু মারফৎ ছোট্ট একটি চিরকূট লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। সেই চিরকুটে লেখা তার সিদ্ধান্তের কথাগুলো ছিল গৌরব-গাথা অসাধারণ দেশপ্রেমবোধ। নির্লোভ নির্মোহ চরিত্রের স্বাক্ষর, শৌর্যবীর্যের প্রতীক। দেশ ও জাতির পরম পবিত্র মহান দায়িত্বের সঙ্গে আপন স্ত্রী পুত্র কন্যার দায়ভার যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত আমার অস্তিত্বের মূলে এক সম্মোহনী শক্তি জুগিয়ে পরবর্তী দুর্গম পথ অতিক্রমের বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছিল।

তাজউদ্দিনের লেখা চিরকূটের কথাগুলো:
“লিলি, আমি চলে গেলাম। যাবার মুহূর্তে কিছুই বলে আসতে পারি নাই, মাফ করে দিও। ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাতকোটি মানুষের সাথে মিশে যেও, কবে দেখা হবে জানিনা.....মুক্তির পর ”।

--দোলন চাপা।


(দোলন চাপা আমাদের ছদ্ম বা গোপন নাম ছিল) সাড়ে সাতকোটি মানুষের সাথে মিশে যেতে সেই সন্মোহনী শক্তির আকর্ষণে যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল।

সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও, দেখাহবে -----মুক্তির পর । কথাগুলোর মধ্যে যেন অপরিসীম শক্তির জাগরণী গানের ধ্বনি। আমার অনুভবে সেই শক্তির এতই গভীরতা, যেন লক্ষ্যে পৌছে যাচ্ছি, তারই চৌম্বকিত পূর্বাভাস। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের দাবানলে তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে নতুন জাগরণে আমরাও অংশিদার হয়ে মোকাবিলা করে চলেছি।

২৫ মার্চ এর পর দু মাস অতিবাহিত হয়েছে, এই দু মাস আতঙ্কিত বিধ্বস্ত অবস্থায় চলার সময় আমাদের পরিচয় নিয়ে এক ভয়াবহ সঙ্কটে পড়ি। ততদিনে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের আম্রকাননে মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানও ঐতিহাসিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতি সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের এক মহান স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেদিনের সেই আইনানুগ সরকারের তৈরি ঘোষণাপত্র পৃথিবীর দেশে দেশে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য।

সেই ঘোষণাপত্রের আবেদনে সাড়া দিয়েছে পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকামী দেশ। তারা সমর্থন জানিয়েছে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত ও প্রসারিত হয়েছে বিজয়ের লক্ষ্যে। তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুদ্ধের প্রতিটি গতি-প্রকৃতি নির্ধারনে রাত-দিন নিরন্তর কাজ করেছেন। তিনি জানতেন না আমরা বেঁচে আছি কিনা। সেই বিধ্বস্ত অবস্থায় চার ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে নদী পথে হেঁটে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কিছু মুক্তিযোদ্ধা বীর ছেলেদের সাহায্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেদিন ভর সন্ধ্যায় হোসেন আলীর বাসায় গিয়ে উঠি।

(হোসেন আলী দুদিন আগে পাকিস্তান এর হাই কমিশনার-এর পদ বর্জন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন) আমার মাথায় প্রায় জট ধরেছে। পরনে নামমাত্র কাপড়, মলিন বিবর্ণ। সেই অবস্থায় হোসেন আলী সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলাম-- “তাজউদ্দিন কোথায়?” তিনি আমাদের বিশ্রাম নিতে বলে বললেন-- “স্যার তো এখানে নেই, ‘মুজিবনগর' অফিসে কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।” বললাম “ফোনে কথা বলা যেতে পারে এখন?” তিনি বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আমাকে ডেকে পাঠালেন।

আমি তখনও কেমন উদভ্রান্তের মতো বিবর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। অগোছালো, চিন্তার জগতে যেন এলোমেলো ঝড়। ফোন ধরতেই তার গলার সেই গম্ভীর আওয়াজ, মনে হল কত যোজন দূরে.............। তিনি বললেন দুটো কথা-- “ও তোমরা এসে গেছ? আমি আসব রাত্রে।" আরও যেন কি বলেছেন আমি আর যেন শুনতেই পাইনি। ফোন হাতে ধরেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি চুপচাপ। হোসেন আলী দ্রুত এসে বললেন, “ভাবি, আপনি যে দাড়িয়ে আছেন! কথা শেষ হয়েছে, আপনি বসুন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-- 'স্যার কখন আসবেন কিছু বলেছেন?' বললাম “রাত্রে আসবেন, সময় জানান নাই।'

অতঃপর হোসেন আলী সাহেব আমাদের বিশ্রাম নিতে বলে বললেন- “স্যার যত রাতেই আসুন, আমি আপনাকে ডেকে দেব।” মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। আবার জীবন ও ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের মিলনের মুহর্তে সিদ্ধান্তের অমোঘ ঘোষণা। সেদিন গভীর রাত্রেই তাজউদ্দিন আসলেন। গাঢ় ক্লান্তির ঘোরে প্রায় অচেতন অবস্থায় প্রতিটা পল যেন কেটে যাচ্ছে, ভেবেছি এই বুঝি এসে পড়লেন। রাত্রি ১টা ২০ মিনিটের সময় তিনি এসে পৌছালেন ঐ বাড়িতে।

দরজায় টকাটক টোকা দেবার শব্দে ধরমড়িয়ে দরজা খুলতেই দেখি হোসেন আলী সাহেব, ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-- “উনি আসেন নাই!" কথা শেষ হবার আগেই জবাব দিলেন-- “স্যার এসে গেছেন।” করিডোর এর ওপাশে দৃষ্টি ফেলতেই দেখি তাজউদ্দিন আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। ঠিক ৩/৪ ফিট দূরে থাকতেই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি যেন হতবিহ্বল, অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি থমকে গেলেন। সেই মুখে কি দেখছিলাম! অমন গভীর রাতে।

ফেলে আসা দু মাসের ভয়ংকর ঘটনাবলির মর্মস্পর্শী বর্ণনা নিজ মুখে তাকে শোনাব বলে যে ছক প্রায় নিশ্চিতভাবে সজ্জিত ছিল আমার মনে, বাস্তব যেন তার অসাধারণ শক্তি দিয়ে নিঃশেষে তা আড়াল করে দিল। যাকে ছোঁয়া যায় না-- সে যে তখন মানুষরূপে এক অসাধারণ মহামানব! দুজনার দৃষ্টি বিনিময়ের সময়টা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ সেকেন্ড। অতি দ্রুত আর একটু কাছে সরে এসে বললেন “লিলি, আসো, তোমার সাথে কথা আছে।" হোসেন আলী অন্য পাশে চলে গেলেন। তাজউদ্দিন ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের দেখে নিলেন কয়েক পল। যেন তাকিয়ে কি দেখছেন! বললেন, “শোনো, আমি ৬/৭ মিনিট সময় হাতে নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের যুদ্ধ চলছে, আমরা এক্সাইলে সরকার গঠন করেছি। আমি এবং কেবিনেটের অন্য চারজন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছি। দেশ পাক হানাদার মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত আমরা কেউ ফ্যামিলির সাথে থাকব না এবং এই শপথের বাণীতে প্রত্যেকের স্বাক্ষর করা আছে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর সহকারে।

আর একটি কথা, কালই এখান থেকে তোমাদের মুভ করানো হবে, কারণ এটা একজন অফিসারের বাসা।” (এটুকু বলেই ঘড়ির দিকে তাকালেন, ওই সময়কালটা ছিল ৫ থেকে ৭ মিনিট)। সেই মুহূর্তগুলোতে এমন গৌরবমন্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে আমি প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম প্রতি- উত্তরের মাধ্যমে নয়। সেই দারুণ শিহরণ জাগানো মতৈক্য প্রকাশ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তার তিনি চলে গেলেন। যাবার মুহূর্তে তার অসাধারণ চাহনিতে কি দেখেছিলাম! সেই সময়ের ওই মহান সিদ্ধান্ত যেন হাজার বছরের এক অমূল্য উপাদান। চলমান জীবনের কত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের উত্থান-পতনের সাথে বারে বারে তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি! ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে এ যে কত বড় অনবদ্য অসাধারণ প্রাপ্তি।

Post a Comment

0 Comments