বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধকঃ সিমিন হোসেন রিমি

যে শিশু জন্মেছিল ১৯৭৫ সালে, আজ সে বাংলাদেশের ৪৪ বছর বয়সী গর্বিত নাগরিক। গর্বিত নাগরিক এইজন্য যে, স্বাধীন দেশের মানুষ সে। পরাধীনতার গ্লানি, নিষ্পেষণ তার মনোজগেক স্পর্শ করেনি। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কঠিন কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের স্রোতকে প্রবলবেগে এগিয়ে নিয়ে গেছে তার জন্মের বহু আগে।

আজও এ বিশ্বে, কত এলাকায় মুক্তিকামী মানুষের আর্তনাদ বাতাসকে ভারি করে তোলে। মুক্তির প্রচেষ্টা স্বাধীনতার স্বপ্ন অবিরাম চলতেই থাকে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ এদিক থেকে বিশাল ভাগ্যবান। দীর্ঘ সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বে স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের গর্বিত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবনপন প্রতিজ্ঞায় যে মানুষটি জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে সংগঠিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন এই বাংলার মানুষকে-- যার ফলে নক্ষত্রসম বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ লাভ করেছে স্বাধীনতা। তার স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতাতেই বিস্তৃতি ছিল না। তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সোনার বাংলার। ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্য, শোষনমুক্ত, উন্নত সুসম বাংলাদেশের।

পাকিস্তানী সেনা শাসকদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষ। লাক্ষ লাক্ষ মানুষ হয়েছে নির্যাতিত, আহত, গৃহহারা। সমস্ত দেশ যুদ্ধের তান্ডবে লন্ডভন্ড। সেই বিদ্ধস্ত দেশকে গড়ে তোলা বিশাল দায়িত্ব পালনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্বস্বাধীন দেশ যখন অগ্রসরমান তখনই দেশীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট স্বপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে বাঙালির চিরকালের বন্ধু জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে চেয়েছিল তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে হত্যা করতে। কিন্তু তারা বোঝেনি ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।

বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছিলেন এই দেশের মানুষকে। তার সমস্ত অন্তর জুড়ে ছিল মানুরেষর জন্য কল্যাণ ভাবনা। প্রতি মুহুর্তে চিন্তায় চেতনায় তিনি নির্মাণ করেছেন স্বপ্নের সিড়ি। স্বদেশের মুক্তির আকাঙ্খায় অনুপ্রেরণা খুঁজে পান বিশ্বের অন্যকোন দেশের মুক্তির স্বাধীনতায়। বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচায় ১৪ই জুলাই ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার লিখে রাখেন “১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসী দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারি নগরীর জনসাধারন সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে।

১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙ্গে রাজবন্দীদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বৎসর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসনী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাই কারাগারের এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালাম জানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারি শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মুক্তিকামী জনসাধারণ এই দিনটির কথা কোনদিনই ভুলতে পারে না।”

উচুঁ প্রাচীর দিয়ে ঘরে রাখা কারাগারের ভেতর বসে সর্বক্ষণই ভাবেন শুধু সাধারণ মানুষের কথা। ২৯ শে জুন ১৯৬৬, বুধবার লিখে রাখেন, “ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির পানি গায়ে লেগে, মশারির একটা অংশ ভিজে গিয়েছে। খুব ঘুমিয়েছিলাম, টের পাই নাই। বৃষ্টি হতেছে মুষল ধারে। যখন বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল তখন হয় নাই, এখন যখন বৃষ্টির প্রয়োজন নাই তখন খুব বৃষ্টি হতেছে। বন্যায় দেশের খুবই ক্ষতি হয়েছে। চাউল তেল ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে।”

শরীরে বৃষ্টির পানি যেনো উপলক্ষ্য। মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কি করতে হবে তার একটি ছক কেটে রাখেন নিজের মনে।
বাঙলার মাঠ প্রান্তর চষে বেড়ানো বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রকৃতিকে যেমন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেন তেমনি মানুষের ভেতরের ভালো এবং মন্দ এই দুইকেই বিবেচনায় রাখেন। ২৩ জুন, ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার লেখেন, “দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করেছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দুর্বার বাগানটার।

ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাষগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ--যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে আনেকগুলি তুললাম”।

সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বহুদিন, বহু মাস, বহু বছর কাটে কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর। জনগণ যেমন আন্তর জুড়ে তেমনি বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান পরিবার তার অন্তরের মনিকোঠায়। ২৪ শে জুলাই ১৯৬৬, রবিবার বাবার লেখা চিঠি পেয়ে প্রতিবারের মতো নতুন করে বাবা-মায়ের খোকা হয়ে যান তিনি। চমৎকার বর্ণনায় তুলে ধরেন বাবা-মাকে। বাবার চিঠির কয়েকটি নাইনও লিখে রাখেন নিজের রোজনামচায়। লেখেন, “বারবার আমার আব্বা ও মা’র কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষন খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারিনা, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষন ফুলের বাগানেরও কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর

কাথাগুলি স্মরন করে একটু শান্তি পেলাম।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়’।
দিনের আলো নিভে গেল, আমিও আমার সেই অতি পরিচিত আস্তানায় চলে গেলাম”।
এভাবেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অনন্য, আত্মপ্রত্যয়ী নেতা, জাতির পিতা। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি যে সোনার বাংলার স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে গেছেন সে স্বপ্নের মৃত্যা নেই। এই স্বপ্নই বাংলাদেশকে জাগিয়ে রাখবে চিরকাল।

সিমিন হোসেন রিমি
জাতীয় সংসদ সদস্য
লেখক ও সমাজকর্মী

Post a Comment

0 Comments