সংগঠন ও মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ নায়ক তাজউদ্দীন আহমদ

সংগঠন ও মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ নায়ক তাজউদ্দীন আহমদ

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানীদের সামনে এক গোলটেবিল বৈঠকে লাহোরে ৬ দফা দাবি পূর্ববঙ্গের অধিকার আদায়ের সনদ হিসেবে উপস্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে। ৬ দফা ঐ বৈঠকে গৃহীত না হলেও বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে নিজ সংগঠন আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছবার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ দফাকে জনপ্রিয় করে তুলতে বঙ্গবন্ধুর বাগ্মীতার সাথে দলীয় সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল প্রধান।


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। দক্ষ সংগঠকের মতন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহকর্মী হয়ে তিনি সেদিন নেতার পাশে পাশে ছিলেন সর্বক্ষণ। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে ও জাতীয় পরিষদ এবং পূর্বপাকিস্তান পরিষদ আওয়ামী লীগ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নীতিমালা মেনে নিয়েও অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল এবং এককভাবে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পশ্চিমা রাজনৈতিক প্রাসাদ চক্রান্ত বাংলার হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিতে কখনই প্রস্তুত নয়, তাই বাদ সাধলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীত্বের আশ্বাস দিয়েও ঢাকায় ডাকা সংসদের প্রথম অধিবেশন অকস্মাৎ বাতিল করে দিলে পূর্ববঙ্গ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়ায় বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ……এই বিপুল জমায়েত দলীয় সাংগঠনিক সক্রিয়তার প্রমাণ। অতঃপর ২৫শে মার্চ ৭১ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো মধ্যরাতে নিরীহ জনগণের উপর।

সাংগঠনিক দক্ষতা ও পারদর্শিতার আরেক প্রত্যয় দৃপ্ত অঙ্গীকারে সাহসী তাজউদ্দীন আহমদ, তরুণ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে, অথচ নিশ্চিত লক্ষ্য অর্জনের অর্থাৎ বাংলার মানুষের মুক্তির আকাঙ্খায় প্রাণমন সঁপে দেয়ার সংকল্প নিলেন তাজউদ্দীন। দেশময় শ্লোগান উঠলো “বীর বাঙালি অস্ত্রধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা,” “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”।

মহানায়ক কারাবন্দী হলেন, কিন্তু বিশ্বস্ত সহযোগী দক্ষ সংগঠক তাজউদ্দীন এবারে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে শুরু হলো মুক্তির সংগ্রাম। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর’কে নিয়ে ভারত-সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা করে নিজ পরিচয়ে বাংলার এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করলেন।

১০ই এপ্রিল ১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। ১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সকল নাগরিক, মুক্তিবাহিনী সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা প্রচার করেন। ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলায় তৎকালীন মহকুমা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। এরপর তিনি জেনারেল ওসমানী, এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে খন্দকার কে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর প্রতিষ্ঠা করে সেনানায়কদের কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে রনাঙ্গণে মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র পাওয়া থেকে সকল রকম ব্যবস্থা করলেন। লক্ষ লক্ষ বাংলার মানুষ ছিন্নমূল অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিলে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন ভারতের সহযোগিতায়।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সুষ্ঠু সাংগঠনিক কাঠামো এবং যুদ্ধ পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কঠিন কাজ সূচারুরূপে সম্পাদনের জন্য কলকাতার থিয়েটার রোডে সরকারের সচিবালয় স্থাপন করেছিলেন। তিনি কেবল সচিবালয় ‘অরবিন্দ ভবন’-এ বসেই থাকতেন না, নিয়মিতভাবে রণাঙ্গন পরিদর্শনে যেতেন এবং মুক্তিফৌজের সাথে থেকে তাঁদের প্রয়োজন ও চাহিদা জেনে তা পূরণের ব্যবস্থা নিতেন।

তাজউদ্দীন আহমদ কেবল মন্ত্রিসভা পরিচালনা, দৈনন্দিন সরকারি কাজকর্ম সম্পাদন ছাড়াও শরনার্থী সকলের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। রণনীতি ও কৌশল পরিকল্পনায় তিনি স্বদেশবাসী জনগণের উপরই নির্ভর করতেন। আর এই মুক্তিযুদ্ধের খোঁজখবর, রণাঙ্গনের মুক্তিবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করা এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞে আতঙ্কিত মানুষের মনোবল অটুট রাখার জন্য ভারত সরকারের সহায়তায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বেতার ট্রান্সমিটার- ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভের ব্যবস্থা করে প্রচারণাকে ব্যাপক ও শক্তিশালী করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকে দক্ষতার সাথে বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী পরিষদ সহযোগীদের নিয়ে ক্রমশভাবে সংগঠিত করেছিলেন যা ছিল জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিমেধা ও শ্রম-এই দুই মৌল চেতনায় ঋদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ দিনরাত কর্মস্থলে কাটাতেন, কোন বিশ্রামের আর বিলাসের কথা চিন্তা করতেন না। তাঁর নিয়মনিষ্ঠ, স্বদেশপ্রেম ও সাংগঠনিক দক্ষতায় মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পররাষ্ট্র বিষয়েও তিনি যত্মশীল ছিলেন আর তাই বিশ্বের তাবৎ মুক্তিকামী জনগণ বাংলার এ জীবনমরন লড়াইয়ে সমর্থন দিয়েছিলেন।

গভীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পারঙ্গমতার বিপুল ঐশ্বর্যে সকল বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানী দখলদার হায়েনাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে, বলিষ্ঠ ও অপরিহার্য নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ডাককে ‘নেতার নির্দেশ’ মেনে গভীর গতিশীলতায় যে সংগ্রাম রচনা করেছিলেন, ভারত সরকারও সহযোগিতার পাশাপাশি বাঙালীর অভ্যূদয় ঘটাতে মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড মিলে ‘মিত্রবাহিনী’ গঠন করেছিলেন এবং বিজয়কে ছিনিয়ে আনতে জানকবুল লড়াইয়ে নামার সাহস দেখিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মন্ত্রীসভার কোন সদস্য বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত নিজ পরিবারের সাথেও দেখা করবেন না। তাজউদ্দীন তা সত্যনিষ্ঠার সাথে পালন করে অরবিন্দ ভবন-এই দিন রাত কাটাতেন।

ন’মাস হলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় জেনারেল ওসমানী, কর্নেল রব ও এ. কে খন্দকারকে নিয়ে যে বলিষ্ঠতার সাথে সচিবালয় থেকে রণাঙ্গন কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন পাকিস্তানী আত্মসমর্পনে, তাই আমাদের বিজয় আর মাতৃভূমিকে পাকিস্তানী কব্জা থেকে পুনরুদ্ধারে সম্ভব করেছিলেন।

কিন্তু যে চক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কাল থেকে তাজউদ্দীনকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করেছিল, সেই খন্দকার মুশতাকের ক্রুর চক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করতে সর্বক্ষণ তৎপর থাকলেও ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেই ২২শে ডিসেম্বর তাজউদ্দীন মন্ত্রীসভার সকলকে নিয়েই মুক্ত স্বদেশে ফিরেছিলেন। অবশেষে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য খন্দকার মুশতাক বিদেশী প্রভূকে তুষ্ট করেছিলেন।

তাজউদ্দীন দক্ষ রাজনৈতিক, মেধাবী পরিকল্পক এবং যোগ্য নেতা হিসেবে আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানী দুঃশাসনের শৃঙ্খল মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি উদার ও মুক্তমানসিকতা, পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। বিনয়ী ও সুস্থ মনের অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন বলেই শ্রেণীবৈষম্যকে বিসর্জন দিয়ে সকল মানুষকে সমান ভাবে ভালবাসতে পেরেছিলেন। আর নেতার প্রতি তাঁর যে আনুগত্য ‘মুক্তিযুদ্ধ বিজয়’ই তার প্রমাণ।

তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ হিসেবে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: কামাল লোহানী, ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক

Post a Comment

0 Comments